ই-সেবা

পছন্দের কিছু লিংক

গুরুত্বপূর্ণ সরকারি লিংকসমূহ

 
 
 
পশু পাখী পালন
মৌমাছি পালন-দীর্ঘ মেয়াদী আয় করা যায়।

 

ভূমিকা: আদিকাল থেকে মৌমাছি মানুষের নিকট অতি পরিচিত এক প্রকার ক্ষুদ্র, পরিশ্রমী ও উপকারী পতঙ্গ। সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে বলে এদেরকে সামাজিক পতঙ্গ বলা হয়। মৌমাছি থেকে আমরা মধু ও মোম পাই । মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। কোন কোন প্রকার মৌমাছি বাক্সবন্দী করে লালন-পালন বা চাষ করা যায়। এবং অধিকতর লাভবান হওয়া যায়।   মৌমাছির প্রজাতি   আমাদের দেশে সাধারণত তিন প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়, যথা: (১)পাহাড়ী মৌমাছি,  (২)ভারতীয় মৌমাছি ও (৩) ক্ষুদে মৌমাছি।


(১)পাহাড়ী মৌমাছি : এরা আকারে সবচেয়ে বড়। বড় বড় গাছের ডালে, পাহাড়ের গায়ে এরা চাক বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ১০ কেজি। এরা পোষ মানে না তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায় না।  


(২)ভারতীয় মৌমাছি : এরা আকারে মাঝারি ধরনের। অন্ধকার বা আড়াল করা স্থান গাছের ফোকর, দেওয়ালের ফাটল,আলমারি, ইটের স্তুপ ইত্যাদি স্থানে এরা চাক বাঁধে। চাক প্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ৪ কেজি। এরা শান্ত প্রকৃতির। তাই বাক্সে লালন-পালন করা যায় ।   
রাণী কোন ধরণের ডিম পাড়বে তা তার ইচ্ছাধীন। নতুন রাণী তৈরী হবে নিষিক্ত ডিম থেকে। শ্রমিক মৌমাছির তত্ত্ববধানে এক বিশেষ ধরণের খাবার (রয়াল জেলী বা রাজসুধা) খেয়ে নতুন রাণী তৈরী হয়। এ খাবারের জন্য সে পরবর্তীতে ডিম পাড়তে সক্ষম হয় ও আয়ুষ্কাল বেড়ে যায়। একটি রাণী মৌমাছির আয়ুষ্কাল প্রায় ২/৩ বছর।   পুরুষ মৌমাছি: এরা মধ্যম আকৃতির । এদের চোখ বড়। কিন্তু এদের হুল নেই। এদের একমাত্র কাজ রাণীর সাথে মিলিত হওয়া । এরা খুব অলস প্রকৃতির । এমনকি এরা অনেক সময় নিজের খাবার নিজেরা গ্রহণ করে না। শ্রমিকেরা খাইয়ে দেয়। রাণীর সঙ্গে শুধুমাত্র একটি পুরুষ মৌমাছি মিলিত হতে সম্ক্ষম । তবে মিলিত হওয়ার পর সেই পুরুষটি মারা যায়। পুরুষ মৌমাছির আয়ুষ্কাল প্রায় দেড়মাস।   


শ্রমিক মৌমাছি : এরা সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির। এদের চোখ ছোট, কিন্তু হুল আছে। রাণী ও পুরুষ বাদে অবশিষ্ট সকল সদস্যই শ্রমিক মৌমাছি। এরা নানা দলে ভাগ হয়ে চাকের যাবতীয় কাজ (যথা চাক নির্মাণ করা, ফুলের মিষ্টি রস ও পরাগরেণু সংগ্রহ করা, মধু তৈরী করা , চাকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, চাকে বাতাস দেওয়া চাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি ) সম্পন্ন করে। এদের জন্ম নিষিক্ত ডিম থেকে এদের আয়ুষ্কাল প্রায় একমাস।    
মধু ও মোম   মধু একান্তভাবে মৌমাছির তৈরী এক প্রকার উপাদেয় খাদ্য। শ্রমিক মৌমাছিরা ফুলের মিষ্টি রস শুষে নেয় এবং তা জমা করে পাকস্থলীর উপরে এক বিশেষ অঙ্গে যাকে মধুথলি বলে। ফুলের মিষ্টি রস মধুথলিতে জমা করার সময় এর সঙ্গে লালা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন উৎসেচক মেশায়। এর ফলে মিষ্টি রস পরিবর্তিত হয়ে আংশিক মধু তৈরী হয়, যা চাকে এনে ঢেলে দেয় মধু রাখার খোপগুলোতে। তরুণ শ্রমিক মৌমাছিরা এ সময় ছুটে এসে ঐ মধু আবার মুখে ভরে এবং তাদের লালার সংগে মিশিয়ে তৈরী করে আসল মধু এবং তা জমা করে খোপে। শ্রমিক মৌমাছিরা জোরে ডানা নেড়ে খোপে রক্ষিত মধু থেকে বাড়তি পানি সরিয়ে দেয়। ফলে এক সময় ফুলের মিষ্টি রস হয়ে যায় ঘন মধু, যা জমা রাখে নিজেদের ও বাচ্চাদের খাবার হিসাবে। মধু জমা রাখার পর খোপগুলোর মুখ মোম দিয়ে বন্ধ করে দেয়। শ্রমিক মৌমাছির পেটের তলায় পকেটের মত ভাজ থাকে মোমগ্রন্থি। সেখানে তৈরী হয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতের মত মোম কণা। এ মোম দিয়ে শ্রমিকেরা বানায় বাসা।  


মৌমাছি পালনের বাক্স : আমাদের দেশে প্রধাণত ভারতীয় মৌমাছি লালন-পালন করা হয়। এ মৌমাছির বাক্স সাধারণত কাঠাল কাঠের তৈরী এবং ২৮.৬ সে.মি x ২৭.৭ সে.মি x ১৭.৪ সে.মি মাপ বিশিষ্ট হয়। এর নিচের দিকে খোলা, যা একটি কাঠের পাটাতনের উপর বসানো থাকে। বাক্সের উপর কাঠের একটি ঢাকনা থাকে। ঢাকনার নিচে সাতটি সমান্তরাল কাঠের ফ্রেম থাকে । এ মৌমাছিরা চাক বাঁধে। এ প্রকোষ্ঠের উপর ফ্রেমসহ আরেকটি প্রকোষ্ঠ বসানো থাকে। উপরের প্রকোষ্ঠকে মধু প্রকোষ্ঠ ও নিচের প্রকোষ্ঠকে বাচ্চা প্রকোষ্ঠ বলে।    


বাক্স রাখার স্থান: যে স্থানটি অপেক্ষাকৃত উচু, নির্জন, ধোয়া অথবা গ্যাসমুক্ত, শুকনো এবং ছায়াযুক্ত এবং আশে-পাশে পর্যাপ্ত ফুল সমৃদ্ধ গাছ-গাছড়া আছে সেখানে মৌমাছির বাক্স বসাতে হয়।   মৌমাছি সংগ্রহ ও কৃত্রিম খাবার প্রকৃত থেকে ভারতীয় মৌমাছি (রাণী ও কিছু শ্রমিক) সংগ্রহ করে অথবা প্রতিষ্টিত মৌচাষীর নিকট থেকে ক্রয় করে মৌচাষ কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়। বাক্সবন্দীর প্রথম ৩/৪ দিন কৃত্রিম খাবার যথা চিনির ঘন সরবত বা সিরাপ দেবার প্রয়োজন হয়। এরপর মৌমাছিরা নিজেদের খাবার নিজেরা সংগ্রহ করে থাকে। কখনো কখনো পরিবেশে খাবার ঘাটতি পড়লে ও কৃত্রিম খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হয়।   


মৌমাছির উপযোগী গাছ-পালা:  মৌমাছির জন্য ফুলের মিষ্টি রস ও পরাগরেণু সমৃদ্ধ গাছ-পালার প্রয়োজন। সারা বছর মিষ্টি রস ও পরাগরেণু সমৃদ্ধ ফুল প্রাপ্তি যাতে নিশ্চিত হয়, সেজন্য নিম্নলিখিত গাছ-পালা মৌমাছি এলাকার আশে-পাশে (২/৩ কিলোমিটারের মধ্যে) স্থানভেদে রোপণ বা চাষ করা যেতে পারে। আম, জাম, কলা, লিচু পেয়ারা, ডালিম, নারিকেল, বেল, কমলা লেবু, ছোলা, সয়াবিন শিমূল ,কার্পাস, কাজু বাদাম ইত্যাদি।  মৌমাছির ঝাঁক বাঁধা   সাধারণত বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে মৌমাছির ঝাঁক বাঁধার প্রবণতা দেখা যায়। বাক্সে মৌমাচছর সংখ্যা বেড়ে গেলে, খাদ্যভাব হলে  মৌমাছিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায়। পুরাতন রাণী উড়ে যাবার পূর্বে শ্রমিকরা চাকে প্রথমে ভাবী পুরুষ ও পরে ভাবী রাণী মৌমাছির খোপ তৈরী করে। এগুলো খুজে বের করে সাবধানে কেটে ফেলে দিলে ঝাঁক বাঁধা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফ্রেমের চাকে নতুন রাণীর খোপ দেখা গেলে সেই ফ্রেম কিছু মৌমাছিসহ নতুন বাক্সে স্থানান্তর করে নতুন চাক তৈর করা যায়।    
মৌমাছির শত্রু : আমাদের দেশে মোমের মথ পোকা মৌমাছির প্রধান শত্রু  এ পোকা চাকে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে শুক্রকীট বের হয়ে মোম খায়। কখনো কখনো থাই স্যাক ব্রুড ভাইরাস দ্বারা মৌমাছি আক্রান্ত হয়ে চাক ধ্বংশ হয়ে যায়। এছাড়া নানাবিধ পাখি, মাকড়সা, টিকটিকি, পিপড়া, ব্যঙ ইত্যাদি মৌমাছির শত্রু । 
এগুলো থেকে মৌমাছি রক্ষা করার জন্য সর্তক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন হয়।  


মধু সংগ্রহ : মধু সংগ্রহ করার সময় আস্ত চাক হাত দিয়ে চিপে মধু বের করা হয়। এ মধুতে মৌমাছির দেহাংশ ও বজ্য পদার্থ বিদ্যমান থাকে। এছাড়া এ ধরনের মধু অশ্প দিনের মধ্যে পচে নষ্ট হয়ে যায়। অপর দিকে বাক্সে লালন-পালন করা মৌমাছির চাক থেকে মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্য মধু বের করা যায়। এতে চাক থেকে শুধু মধু বের হয়ে আসে, অথচ চাক নষ্ট হয় না এবং তা আবার ব্যবহার করা যায়।   


মৌমাছি পালনের উপকারী দিকসমূহ :  ক) দেশে খাটি মধুর চাহিদা পূরণ করে পুষ্ঠিহীনতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । কারণ মধু শর্করা জাতীয় খাদ্য। যা বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন,এনজাইম ও খনিজ পদার্থ থাকে।  খ) মধু রোগ (যথা: সর্দি, কাশি,বাত, ব্যাথা ইত্যাদি) জীবানুনাশক হিসাবে ব্যবহার করে।  গ) মোম, মোমবাতি, প্রসাধন (কোল্ড ক্রীম, সেভিং ক্রীম, স্নো ইত্যাদি) ঔষধ (বিভিন্ন মলম তৈরী ব্যবহার হযে থাকে)   ঘ) মধু ও মোম বিক্রয় করে বাড়তি আয়ের সংস্থানের মাধমে পারিবারিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি করে যা সার্বিকভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির দারিদ্র্য দূরীকরনের সাহায্য করে।  ঙ) ফুলের পরাগায়নের মাধ্যমে কৃষিজ, ফলদ ও বনজ গাছ-পালার ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করে ও জীব বৈচিত্রে সংরক্ষনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।