ই-সেবা

পছন্দের কিছু লিংক

গুরুত্বপূর্ণ সরকারি লিংকসমূহ

 
 
 
কৃষি উদ্যোগ
টিস্যুকালচার পদ্ধতিতে রাজশাহীঅঞ্চলের কৃষিতে নীরব বিপ্লব

আনু মোস্তফা, রাজশাহী

রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা নিম্নমানের আলুবীজের ওপর নির্ভর না করে টিস্যুকালচার আলুবীজের দিকে ঝুঁকছে। টিস্যুকালচার বীজ ব্যবহার করে কৃষকরা আলুর ভালো ফলনও পাচ্ছে।

এদিকে ভালো বীজপ্রাপ্তির লক্ষ্যে এবং ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় রাজশাহীর বাগমারা, তানোর, মোহনপুর, পবাসহ বিভিন্ন এলাকায় কৃষকপর্যায়ে গড়ে উঠেছে শতাধিক টিস্যুকালচার নেট হাউস আলবীজ খামার। বীজ আলু উৎপাদন করে কৃষকপর্যায়ে বিক্রি করে বিপুলভাবে লাভবানও হচ্ছে তারা।
রাজশাহী কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তিন বছরে নেট হাউসের মাধ্যমে টিস্যুকালচার আলুবীজ উৎপাদন করে দারুণ সাফল্যের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে রাজশাহীর বহুসংখ্যক কৃষক। রাজশাহীর পবা উপজেলার শুধু ঘিপাড়া গ্রামের অর্ধশতাধিক চাষি নেট হাউসে আলুবীজ চাষ করে লাখপতি হয়েছে। ঘিপাড়ার মোস্তাফিজ তিন বছর আগে শুধু নেট হাউসে এক হাজার প্ল্যান্টলেট এবং এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করে লাখপতি হয়েছেন। মোস্তাফিজ জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ছয় হাজার প্ল্যান্টলেট (বীজআলুর গাছ), পাঁচ বিঘা জমিতে পিএফ (প্রি-ফাউন্ডেশন)সহ মোট আট বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। আলুর ফলনও হয়েছে ভালো। মোস্তাফিজ আশা করছেন এবার তিনি ২০ লাখ টাকার আলু পাবেন।

ঘিপাড়ার জাকির মাস্টার জানান, কৃষিবিদ থেকে শুরু করে শত শত কৃষক তাঁকে চিনে শুধু নেট হাউস আলুবীজ উৎপাদনের কারণেই। তিনি আলুবীজ চাষ করে এবার দুই লক্ষাধিক টাকা লাভ করবেন বলে আশা করছেন। জাকির মাস্টার আরো জানান, তাঁরা প্রায় ৮০ জন কৃষক কয়েক বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মনজুর হোসেনের কাছ থেকে মাঠপর্যায়ে আলুবীজ উৎপাদনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। অধ্যাপক মনজুর কৃষকদের প্ল্যান্টলেট ও বীজ আলু সরবরাহ করেছেন। এতে শতাধিক কৃষক এবার বীজ আলু উৎপাদন করে লাখপতি হয়েছে। ঘিপাড়া গ্রামের আরিফ, হাসেম, শরিফুল, প্রফুল্ল কুমার ও রাজ্জাক_এ রকম অর্ধশতাধিক কৃষক বীজ আলু চাষ করে লাভবান হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। গোদাগাড়ী উপজেলার মান্ডইল গ্রামের ওয়াসিম সরকার, মজিবর রহমান, তানোরের কাসিমবাজারের আব্দুর রশিদ, গাগরন্দ গ্রামের আব্দুল মালেক, মোহনপুরের খানপুরের নুর আলম, খাড়ইলের সুকুমার এবার নেট হাউসে বীজ আলু চাষ করে সফল হয়েছেন। তাঁদের আবাদও ভালো হয়েছে। বাগমারা মচমইল ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফাত্তাহ বলেন, ‘অন্যদের দেখাদেখি তিনিও নেট হাউসের মাধ্যমে টিস্যুকালচার আলুবীজ খামার করেছেন। আশা করছেন, বেশ লাভবান হবেন।’

এদিকে আলুর এই মৌসুমে রাজশাহীর কৃষকদের বীজ উৎপাদনে নেট হাউসগুলো পরিণত হয়েছে কৃষি উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ এক দর্শনীয় ক্ষেত্রে, যা নিয়মিত দেখতে আসছেন কৃষক, গবেষক ও কৃষি কর্মকর্তারা। এসব নেট হাউস দেখতে আসা জাপানি কৃষিবিদ সাইতে মাসাশি বলেন, ‘কৃষকদের মাঠপর্যায়ে এই সাফল্য দেখে আমি খুবই খুশি। বাংলাদেশের কৃষকদের এসব উদ্ভাবন আমার খুব ভালো লেগেছে।’ জাপানি ফ্যাশন ডিজাইনার ও গবেষক সুজুকি বলেন, ‘কৃষকের এই সবুজ ফসলের মাঠ দেখে আমি আনন্দিত। আমার ভালো লেগেছে নতুন এই কৃষিপ্রযুক্তি শিখে কৃষকদের মাঠে কাজ করার বিষয়টি। আশা করি, এ দেশের কৃষকরা সময়ের সঙ্গে এগিয়ে যাবে।’

আলুবীজ উৎপাদনের এই সাফল্যে দারুণ আশাবাদী টিস্যুকালচার আলুবীজের অন্যতম গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি ১৯৮৭ সাল থেকে টিস্যুকালচারের আলু নিয়ে গবেষণার কাজ করছি। টিস্যুকালচার-পদ্ধতি উদ্ভাবিত হওয়ায় উন্নতমানের বীজ আলু তথা সামগ্রিক আলু উৎপাদন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। টিস্যুকালচারের মাধ্যমে উন্নতমানের রোগমুক্ত বীজ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। বীজে কোনো প্রকার অণুজীব বা ভাইরাস সংক্রমণ যাতে না ঘটে, সেজন্য বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ফলে এ বীজ ব্যবহার করে কৃষকেরা ভালো ফলন পাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, টিস্যুকালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করে বাংলাদেশে আলুর ফলন দ্বিগুণেরও অধিক বৃদ্ধি করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ রবীন্দ্র কুমার মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশে আলু একটি বিরাট সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে সবজি হিসেবে খাওয়া হলেও এটি সম্পূরক খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়। কিন্তু গড়ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় মাত্র ১২ টন, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। দেশে টিস্যুকালচারের আলুবীজের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে।’ এই চাহিদা মাথায় রেখেই রাজশাহীতে কৃষকপর্যায়ে গড়ে উঠেছে শতাধিক টিস্যুকালচার বীজ উৎপাদন খামার, যা জন্ম দিয়েছে এক নীরব কৃষি বিপ্লবের।’